Friday, February 20, 2009

সম্পাদকীয় - অলোক ১৪১১

সম্পাদকীয়

সৈয়দ আহমদ শামীম

অলোক-১৪১১


সভ্যতা বিকাশের একটি সুন্দর উপায় সাহিত্য। সাহিত্যের সাথে আনন্দ যুক্ত থাকে। থাকে দায়িত্বও। সমাজ ও সভ্যতার চরিত্র কি হবে বা কি হচ্ছে তার পরিচয় সাহিত্যে ব্যক্ত হয়। সাহিত্যের যারা মানুষ তাদেরকে জাতির অগ্রণী পুরুষ বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ সমাজ ও সময়ের দূষিত বাতাবরণ থেকে তারা মানুষকে মুক্ত করার প্রয়াস পান। সাহিত্যিক জোর খাটান না। কেননা মনের উপর জোর চলে না। সাহিত্যিক সেটা জানেন। অথচ সাহিত্য দ্বারা মন সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট হয়। সাহিত্যের এই শক্তিকে তাই ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন দেশকালের বিভিন্ন সাহিত্যিকগণ। পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্যিক ও মনীষীগণ যে সব মহৎ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন তা মানব সমাজের অমূল্য সম্পদ। সে সব সাহিত্যকর্ম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে সত্যের প্রতি। মানবতা ও কল্যাণের প্রতি। পৃথিবীর যে কোন ভাষার সৎ সাহিত্য আমাদের জন্য পাথেয় স্বরূপ। দেশ জাতি ও সভ্যতা সমূহের মধ্যে যে সংঘাত বিরাজমান তা বেরুবার দিক নির্দেশনা আমরা পেতে পারি মহৎ সাহিত্য কর্মে।

তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল সত্য, সুন্দর ও সৌহার্দের প্রতি আধুনিক মানুষের আগ্রহহ্রাস পেয়েছে। ধৈর্য, সংযম, সততা ইত্যাদির চাইতে অসহিষ্ণু মনোভাব, অসততা ও উদ্ধত মনোভাব তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। জৌলুস ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের দিকে তাদের আগ্রহ। দেখানোপনা ও খ্যাতির কাঙ্ক্ষাই যেন জীবনের লক্ষ্য। মননের সমৃদ্ধির চাইতে বাহ্যিক বেশভূষা দাপুতে জীবনের প্রতি নিরন্তর ছুটে চলা। বদলে গেছে তাদের মানস্কাঠামো। ফলে একজন রবীন্দ্রনাথ চাইতে টেন্ডুলকার তাদের কাছে বড়ো। শেক্সপিয়ারের চাইতে ব্যকহাম। গ্যাটের চাইতে ক্লডিয়া শেফার। আধুনিক মানুষ একজন Hair Expert কে যতোটা মূল্য দেন একজন এডওয়ার্ড সাঈদ বা নোয়াম চমস্কিকে ততোটা নয়।

এদের জীবনের অনিবার্য অবলম্বন হল ভোগলিপ্সা ও বিনোদন। কেনাকাটা ও ভ্রমণ। পৃথিবীর শহরগুলোর তাকালে দেখব মোড়ে মোড়ে খাবার দোকান ও শপিং মল। কোথাও কোন লাইব্রেরি গড়ে ওঠে না। কেবলই বহুতল শপিং সেন্টার। আর স্পোর্টস। আছে মডেল তারকা ফুটবল তারকা ক্রিকেট তারকা। উদ্দাম সংগীত। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মডেল তারকার জীবন বৃত্তান্ত তারা জানে। জানে না আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কে। কেন আমেরিকানরা আর কবিতা লিখতে পারছে না। কেন টলস্টয়ের মতো জমিদার সন্তানকে জনশূন্য ট্রেন স্টেশনে মরে পড়ে থাকতে হয়েছিল। আধুনিক মানুষের এই অজ্ঞতা ও অবিমৃশ্য জীবনবোধ একটি স্থুল সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। ফলে আর সকল সকল কিছুর মতো শিক্ষা হয়ে গেছে পণ্য। জ্ঞানার্জনের নামে মানুষ এখন হাজার হাজার তথ্যই কেবল ঠোঁটস্থ করছে। প্রকৃত জ্ঞান ও জ্ঞানজাত সত্যবোধ মানুষ অর্জন করতে পারছে না। পরিণামে বাড়ছে মানুষে মানুষে দূরত্ব। জাতিতে জাতিতে ভুল বোঝাবোঝি। এক কুটিল ও স্বার্থপর পৃথিবীর দমবন্ধ করা বাতাসে মানুষের কী করুণ অবস্থা।

আমাদের ভবিষ্য সন্তানেরা সভ্যতাকে পাল্টে দেবে। তাদের রচিত সাহিত্যে সে সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। তারা এই স্বার্থপর, ভোগলিপ্সু ও নির্মম পৃথিবীর পরিবেশটাকে করে তুলবে মানবিক ও প্রীতিপূর্ণ। নিছক তথ্য নয়, তারা অর্জন করবে জ্ঞান। যে জ্ঞান তাদেরকে সত্যের প্রতি তথা মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল করে তুলবে।

আমাদের অলোক এ সে সত্য পৃথিবীর বীজ উপ্ত হয়েছে নিশ্চয়।