Monday, July 27, 2009

টিপাইমুখ বনাম গণশক্তি

টিপাইমুখ বনাম গণশক্তি
- মাসউদুর রহমান

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বরের পর ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশীদের জন্য সবচে’ গৌরবোজ্জ্বল দিন বলে আমি মনে করি। এদিন বাংলাদেশের সৈনিক জনতা কুড়িগ্রামের রৌমারি সীমান্তে ভারতীয় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ সৃষ্টি করে তাদের অন্যায় দখল প্রচেষ্টা প্রতিহত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। ভারতীয় বিএসএফ, ব্ল্যাকক্যাট এবং সর্বোপরি সে দেশের সেনাবাহিনী টের পায় আমাদের জনগণের রাম দা আর লাঠির জোর কতখানি। ব্ল্যাকক্যাট এবং সেনাবাহিনীর কথা বলছি এজন্য যে, সেদিনের সেই অপারেশনে বিএসএফের সাথে তারাও অংশ নেয় বলে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। এরপরের সবকিছুই তো আমাদের জানা। ভারত অন্যায়ভাবে অতর্কিত হামলা চালালেও বাংলাদেশের তৎকালীন মেরুদন্ডহীন সরকার ভারতের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। তিরিশ বছর ধরে বেদখলে থাকা আমাদের মাটি নিজেদের দখলে এনেও ফের ভারতকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল সরকারী নির্দেশে।

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও সংকটটা একই দিকে মোড় নিচ্ছে মনে হয়। বর্তমান শাসকগোষ্ঠির কথাবার্তায় আচরণে মনে হচ্ছে, টিপাইমুখ বাঁধ হলে যেন তাদের লাভ। দেশের বিশাল একটি অংশ এই বাঁধের ফলে স্বাভাবিকভাবেই মরুভুমিতে পরিণত হবে। এমন অবস্থায় সরকারের মিউ মিউ স্বরে মার্জারিয় অবস্থান আমাদের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করে, এর বিরুদ্ধে কথা বলতে সরকার ভয় পাচ্ছে কেন? সরকার নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের ভোটে, ভারতের টাকায় বা ভারতের সহযোগিতায় নয়। সরকার কি জনগণের জন্য না ভারতের স্বার্থে কাজ করবে, আমরা তা জানতে চাই। আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে ভারত কখনোই এটা করতে পারবে না, যদি না সেখানে সরকারের সমর্থন থাকে।

১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম অস্ত্র ছিলো ফারাক্কা বাঁধ। প্রচারণায় এভাবেই বলা হতো ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের উদাসীনতাই দায়ী। নির্বাচনে অত্র অঞ্চলে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে আর মুসলিম লীগ সেই যে ডুবেছে আর ভেসে ওঠেনি। আমাদের স্বাধীনতার প শক্তি বলে দাবীদার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি কঠোরভাবে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ করতে না পারে তবে আগামী প্রজন্ম জামাতে ইসলামী নয়, রাজাকার দালাল বলে চিহ্নিত করবে আওয়ামী লীগকে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই অপরাধ আরো গুরুতর। বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে আমরা দেখিনি। তাই তাঁর ব্যাপারে আমাদের কোন অনুভূতি কাজ করে না। কিন্তু আমরা শেখ হাসিনাকে দেখেছি। আগামী প্রজন্ম শেখ মুজিবকে জাতির পিতা বলে মন থেকে গ্রহণ করবে, নাকি শেখ হাসিনার পিতা বলে ঘৃণা করবে, সে সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ভারতের দুর্বিনীত হাই কমিশনারের এদেশের রাজনীতিবিদ এবং পানি বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে অশোভন উক্তিতে মিসেস মনির নির্লিপ্ততা প্রমাণ করে যে, তার কোন মেরুদন্ড নেই এবং বাংলাদেশী হিসেবে তার কোন আত্মমর্যাদাবোধও নেই। অন্যদিকে বানিজ্যমন্ত্রীর হাস্যকর একটি উক্তি, “টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর হলেই তারা এই বাঁধ নির্মাণে সমর্থন জানাবেন।” একথা তো একটি শিশুও বুঝতে পারে যে, নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করলে ভাটির জন্য তা কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। সর্বোপরি যেখানে ফারাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। একটি শিশুর বোধ-বুদ্ধি যখন একজন পরিণত বয়ষ্কের মধ্যে পাওয়া যায় না, তখন আমরা তাকে কথ্য ভাষায় বেকুব বলি। যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরুদন্ডহীন এবং বানিজ্যমন্ত্রী বেকুব, সে দেশের মন্ত্রীপরিষদের দেশ পরিচালনা নিয়ে আমাদের বড়ই দুশ্চিন্তা হয়।

আরেকটি বিষয় আমাকে অবাক, হতবাক, আশ্চর্যান্বিত এবং বিস্ময়বিমূঢ় করে দিয়েছে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে সেক্টর কমান্ডারদের নির্লিপ্ততা। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাদের গর্জে ওঠার ব্যাপারে কোন একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়েছিল যে, তারা যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক প্রচারণার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর কাছ থেকে বিপুল অংক উৎকোচ হিসেবে নিয়েছিলেন। আমরা সেটা বিশ্বাস করি না। কিন্তু টিপাইমুখ একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এর সাথে অবশ্যই আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত। এ ধরণের রাষ্ট্রীয় সঙ্কটময় ইস্যুতে সেক্টর কমান্ডারদের অস্বাভাবিক নিরবতা আমাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাদের উচিৎ ছিল এই ইস্যুতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গর্জে ওঠা। জাতি আবার তাদের ডাকে তাদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হবে। কে জানে, এ জন্য তারা হয়তো পাকিস্তানের আইএসআই এর কাছ থেকে উৎকোচের অপো করছেন। যদিও আমরা এটাও বিশ্বাস করি না। সেক্টর কমান্ডারদের বলি, সরকারকেও বলি, শ্রদ্ধাভাজন কবি-সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, যারা একবার দেশের সাথে বেঈমানী করে তারা চিরজীবনের জন্য রাজাকার, আর একবার যুদ্ধ করেই সারা জীবন মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি ব্যবহার করা যায় না।

পরিশেষে নিবেদন, সরকারের কাছে এবং দেশবাসীদের কাছে, ২০০১ সালে যদি ৩০ জন সৈনিক আর নিরস্ত্র গ্রামবাসীরা মিলে ভারতের অতর্কিত আক্রমণ, ৩০০ সুসজ্জিত সৈন্যের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি মর্টার শেল দিয়ে আক্রমণ, প্রতিহত করতে পারে, তাহলে সরকারের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। ভারতের সামরিক সৈন্য সংখ্যা সব মিলিয়ে একত্রিশ লক্ষ যার ১৩ লক্ষ সক্রিয় আর বাকীরা রিজার্ভ বেঞ্চে, কিন্তু সরকারের মনে রাখতে হবে আমাদের জনসংখ্যা ১৭ কোটি। তাই সরকারকে হুজুর হুজুর মার্কা পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। একই সাথে বিরোধী দলকে অনুরোধ জানাচ্ছি, ইস্যুটিকে ব্যবহার করে সরকার পতনের প্রচেষ্টায় না নেমে বরং রাষ্ট্রের স্বার্থকে রাষ্ট্র ও জনগণের জায়গা থেকে দেখে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিহত করার নিখাদ এবং সক্রিয় আন্দোলনের ডাক দিতে। নতুবা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেরাই রুখে দাঁড়ানোর সাথে সাথে জনগণ সরকারী, বিরোধী দল উভয়ের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াবে। টিপাইমুখ অভিমুখে অভিযান শুরু করার আগে জনগণ অবশ্যই গণভবন, বঙ্গভবন এবং সংসদভবন পাক পবিত্র করেই রওনা দেবে। কেননা কোন নপুংসক সরকার কিংবা সুযোগসন্ধানী নিষ্ক্রীয় বিরোধী দলের বাংলাদেশী জনগণের কোন প্রয়োজন নেই।