Tuesday, April 21, 2009

বেলা শেষে

বেলা শেষে
আব্দুল ওয়াহেদ

সকল অনুভূতি জট পাকিয়ে গেছে। যেন আমার ভেতর আমি নাই। জানি না কি হচ্ছে চারপাশে। হাটছি, বসছি, কথা বলছি কিন্তু এগুলো কোনটাই আমার কাছে ধরা পড়ছে না। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছি। শূন্যতার কুয়োর মধ্যে পাক খাচ্ছি। হাত ধরে কে আমায় টেনে তুলবে। জানি না, জানি না!! গতকাল থেকে এই অসহ্যকর নিরবতার বাসিন্দা আমি। কতজন কতো সান্ত্বনার বাণী দিয়ে যায়, কিছুই যেন কানে আসে না।

সারারাত অদ্ভুত ঘোরের মাঝে গেছে। বারবার দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। ক্লান্তি জমে আছে, অথচ মুখ ফুটে কিছু বলে না। এই করে সারাটা রাত কেটে গেলো। সুবহে সাদেকের সময় দরোজা খুলে বারান্দা এসে বসি। এখানে সকাল বিকাল কফির মগ হাতে বসতাম।

দেয়ালের ওপাশে সাপের মতো আকাঁ বাকাঁ রাস্তাটা চলে গেছে। তার পাশে নানান গাছে অন্ধকার হয়ে থাকা রহস্যময় জমাট পাহাড়, এখন আর কোন রহস্যের জানান দিচ্ছে না। ব্যালকনিতে বসে বসে দেখতাম এই ছোট্ট পথ দিয়ে কত কিসিমের লোক হেটেঁ যায়। কতো দিন আমি মিশু নিলু এই পথে হেটেঁ গেছি। কে না ছিলো আমাদের সাথে, বৃক্ষ, চাদঁ, তারা, বিশ্ব চরাচর। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত সব ঋতু। সবকিছুকেই আজ দূরে মনে হচ্ছে।

মাহফুজকে ফোন করলাম। একা একা ক্যাম্পাসে যেতে পারব না।
ও আসলো। একসাথে ক্যাম্পাস গেলাম। বলার কিছু নাই। খানিকক্ষন এদিক ওদিক ঘুরলাম। ফাঁকা ক্যাম্পাস, এতো সকালে কেউ আসে না। দু'জনে অনেকক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম।

ঘন্টাখানেক পর মিতুল ম্যাডামের সাথে দেখা। ম্যাডাম বললেন, কেমন আছো? বলার জন্য বলা। তিনি নিজেও জানেন আমি কেমন আছি। বললেন, তোমার স্যার গতকাল রাতে ঘুমাতে পারেন নি, কেদেঁছেন। শুধু বলছেন, তোমার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো। ' আমি কিছুই বললাম না। আমার বলা আর না বলাতে কি আসে যায়। আমার নিজেরও কিছু আসে যাই না।

নিরবতাকেই সত্য বলে জেনেনি। সে আমার সঙ্গী হবে।

তারপর কি হবে?
এই চেনা জানা পথ অচেনা অজানা হয়ে যাবে। এমনিতেই হতো। আজ না হয় কিছু কষ্ট নিয়ে গেলাম।

আমার গুরুর কাছে গেলাম। তার চেহারায় কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। একমুহুর্ত নিরবতার পর তিনি রেজাল্ট নিয়ে নানা কথা বললেন। আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। আমার সান্ত্বনার দরকার ছিলো না। আমি বললাম, আমাকে নিয়ে দুঃখ পাবেন না। আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে। হয়তো পথ অচেনা, কিন্তু আমার বিশ্বাসই আমাকে সেই পথে নিয়ে যাবে।

তাহলে আমার ভেতর এতো কষ্ট কেন?
নিজেকে অনুভূতিহীন করার যন্ত্রণা নিজে তো যন্ত্রণা। এর চেয়ে এই দুঃখ ভালো। জগতের শুদ্ধতম অনুভূতি হলো দুঃখ। এই শুদ্ধতম অনুভূতিই আমাকে শুদ্ধতম বোধে পৌছেঁ দেবে। সমুদ্দুর যখন পাড়ি দিতে হবে, তবে কেন-ই বা ভাবব যেমন তেমনভাবে পাড় হলেই হবে। এই জীবনের মানে পরিপূর্ণভাবে জানতে হবে। তা নাহলে পিপাসা মিটবে না। হয়তো অতৃপ্তি নিয়ে চলে যাওয়াই মানুষের নিয়তি। কিন্তু সে তো ততটুকুই পেয়েছে, যতটুকু চেয়েছে, ধরতে পারুক আর না পারুক। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে ক্ষুদ্র না। সে শেষ মুহুর্ত পয্যন্ত লক্ষের দিকে এগুতে থাকে।

শেষ পয্যন্ত সেই অসম্ভব নিরবতা আর নির্মম সময় উপস্থিত। আমাকে যেতে হবে। আমাদের দুজনের চোখ ভেজা। একসময় বললাম, স্যার আপনার পা ছুয়েঁ সালাম করব'। আমার সামনে দুনিয়াটা উলটে পালটে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। এই আবেগ আর সহ্য হচ্ছিল না। আহ.. আমি যদি অনুভূতিহীন হতাম, অন্তত এই মুহুর্ত্।

তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

........... রাতের বাসে ফিরছিলাম।
মন খারাপ। বিশ্ব চরাচরে আমরা যেন শেষ মানুষের দল, যারা নতুন পথের সন্ধানে পাড়ী দিচ্ছে অন্তহীন সমুদ্দুর। লোকালয়ে জন মানবের কোন নির্দেশ নাই। চাদেঁর আলোয় অস্পষ্ট পিচঢালা রাস্তাটাই শুধু চিকচিক করছিল। যেন অনাদি কাল ধরে সংরক্ষিত জঙ্গল পাড়ী দিচ্ছি। একমাত্র সঙ্গী চির চেনা চাদঁ।

চাঁদকে বললাম, তুই আমার সাথে যাবি।
চাঁদ হাসি দিয়ে নতুন আলোতে সকল কিছু ভাসিয়ে নিলো।