Sunday, March 1, 2009

আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক কে ছিলেন ?

আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক কে ছিলেন ?-

আব্দুল হালীম খাঁ

বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে যে, ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন আল কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক। এ প্রচারণার কিছু কারণ ছিল। বৃটিশ আমলে এদেশে ব্রাহ্মধর্মের একটা জোয়ার এসেছিল। গোঁড়া হিন্দু ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন এক সময় হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মধর্ম এ দেশে ছিল একটি নতুন ধর্মমত। তাই এ ধর্মমত আপামর জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য গিরীশ চন্দ্র নিজে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু অর্থকড়ির তো প্রয়োজন। সেটা আসবে কোথেকে! তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমানদের পকেট থেকে টাকা বের করার জন্য বেশকিছু ইসলামী বই রচনা করলেন এবং সেই সাথে পবিত্র আল কুরআনের অনুবাদ করে প্রকাশ করলেন। মুসলমানরা এ বই কিনলোও প্রচুর। ফলে বাংলা ভাষাভাষী যারাই কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ হাতে পেতে চাইলো তাদের হাতে পৌঁছে গেল তার অনূদিত কুরআন শরীফ। এ ব্যাপারে তাঁকে ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু ব্যক্তিবর্গ এমন কি বৃটিশরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। ফলে মানুষ মনে করেছে পবিত্র কুরআন শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হচ্ছেন ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন। আসলে পবিত্র কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী যে মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন সে কথা অল্প কিছু লোক জানলেও ব্যাপকভাবে প্রচার করার সুযোগ আসেনি। গিরীশ চন্দ্র কুরআনের অনুবাদ বিক্রি করে যে অর্থ লাভ করতেন তা ব্যয় করতেন ব্রহ্মধর্ম প্রচার কাজে। ফলে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের মিশনের সাথে কুরআন বিক্রয়ের একটা গভীর সম্পর্ক ছিল।
মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ছিলেন একজন মুসলমান। তিনি স্বত:প্রণোদিত হয়ে আল কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। তা প্রচারের জন্য গিরীশ চন্দ্র সেনের মতো কোনো মিশন ছিল না। যার কারণে তার প্রচার প্রসার ছিল সীমিত। এমনি করেই আল কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হয়েও মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের মতো প্রচার পেতে পারেননি।
মৌলবী নঈমউদ্দীন ছিলেন প্রকৃত ইসলামী চিন্তাবিদ, সুসাহিত্যিক, ইসলাম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, সুবক্তা এবং মানবপ্রেমিক। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলায় আল কুরআনের অনুবাদকারী হিসেবে অক্ষয় গৌরব অর্জন করেছেন। সেজন্য মুসলিম সমাজ তাঁকে চিরকাল অসীম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন।
বর্তমানে বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের অনেক অনুবাদ-তফসীর প্রকাশিত হয়েছে। অথচ একশত বছর পূর্বে এর একটিও ছিল না। অবিভক্ত বাংলার জ্ঞানরসহীন বিশাল মরুভূমিতে কী অপরিসীম প্রাণাবেগে ও আকাáক্ষায় বক্তৃতা দিয়ে ঝড়ের মতো দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন একজন আলেম-উদ-দহর মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন তা ভাবতে আজ অবাক লাগে। করটিয়া থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বার্মা সিলেট, সিলেট থেকে রংপুর, তারপর কলকাতা, কলকাতা থেকে আসাম, বিহার আর দার্জিলিং ছিল তাঁর হাতের তলা যেনো।
এই মহা মনীষীর ত্যাগ ও সাধনার উপর ভিত্তি করে আজ সমাজ ও জাতি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। সমাজ যে প্রদীপ থেকে আলো পেয়ে আলোকিত হয়েছে, সমাজ এখন সেই আলোর মূল উৎসকেই ভুলে গেছে। বর্তমান সমাজের তরুণেরা তো দূরের কথা, প্রবীনেরাই তাঁকে ভুলে গেছে। তাঁর রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলো এখন আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। বড়ই দু:খের বিষয়, নামটিও একেক লেখক একেকভাবে লিখেছেন। কেউ তাঁর নামের আগে ‘মৌলবী’ লিখেছেন, কেউ লিখেছেন ‘মুন্সী’। কেউ নামের সঙ্গে মোহাম্মদ যুক্ত করেছেন, কেউ বাদ দিয়েছেন। নামটিতে কেউ ‘ঈ’ আবার কেউ ‘ই’ ব্যবহার করেছেন। উদ্দীনকে কেউ ‘ম’-এর সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে ‘নঈমুদ্দীন’ এবং কেউ ‘নঈমউদ্দীন’ লিখেছেন। কেউ কেউ আবার মূল নামটি ‘’ৈ দিয়ে ‘নৈমুদ্দীন’ লিখেছেন।
বাংলা ভাষায় কোনো খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম বোধহয় এতো নানা রূপে বিকৃত করে আর লিখা হয়নি। এই বিকৃতিরীতি মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীনের প্রতি অবজ্ঞা ও অজ্ঞানতার পরিচয় বহন করে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
মৌলবী নঈমউদ্দীন সম্পর্কে তাঁর পুত্র মৌলবী রোকন উদ্দীন আহমদ তাঁদের খানদানী কুরছিনামা থেকে যেসব তথ্য পরিবেশন করেছেন তাতে দেখা যায় যে, তাঁদের পূর্ব পুরুষ শাহ সৈয়দ মুহাম্মদ খালেদ বাগদাদ থেকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমন্ত্রণক্রমে দিল্লীতে আগমন করেন। তাঁর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের দিল্লী থেকে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকায় বিবাহ করে মানিকগঞ্জের গালা গ্রামে স্খায়ীভাবে বসবাস করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা ‘সৈয়দ’ উপাধি ত্যাগ করেন এবং গালা গ্রাম থেকে টাঙ্গাইল জিলার করটিয়ার নিকটবর্তী সুরুজ গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ১৮৩২ সালে সুরুজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছলিমউদ্দীন এবং মাতার নাম তাহেরা বানু।
পিতার নিকট থেকে আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষা শিক্ষা লাভের পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য নঈমউদ্দীন ঢাকা চলে আসেন এবং আট বৎসর কাল এক বিশিষ্ট আলেমের তত্ত্বাবধানে থেকে আরবী ফারসী ও উর্দু ভাষায় এবং হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ ও মান্তেক প্রভৃতি শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। অত:পর তিনি বিহার, এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ, জৌনপুর, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি স্খান পর্যটন করেন। এসব স্খানের খ্যাতনামা আলেমদের নিকট থেকে প্রভূত জাহেরী ও বাতেনী বিদ্যা আয়ত্ত করেন। তিনি তাঁর সর্বশেষ উস্তাদের নিকট থেকে আলেম-উদ-দহর উপাধি লাভ করে ৪১ বৎসর বয়সে স্বগৃহে ফিরে আসেন।
সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন আলেম-উদ-দহর অর্থাৎ জ্ঞান সুমদ্র। তৎকালে হিন্দু সমাজে যেমন ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মুসলিম সমাজে তেমনি ছিলেন মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন। গ্রামে ফিরে এসে তিনি সমাজের উন্নতিকল্পে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি সর্ব প্রথম লক্ষ্য করলেন যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্খা ও রীতি থেকে বিচ্ছিন্নতাই মুসলমানদের অধ:পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু ইসলামী শিক্ষা লাভের জন্য মুসলমানদের যেমন আগ্রহ নেই, তেমনি কোনো সুযোগ সুবিধেও নেই। ইসলামী জ্ঞান লাভ করার জন্য বাংলা ভাষায় কোনো গ্রন্থ নেই। অল্প শিক্ষিত মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব নয় মূল আরবী ও ফারসী ভাষা থেকে জ্ঞান আহরণ করা। মৌলবী নঈমউদ্দীন জানতেন একমাত্র সাহিত্য সঞ্জীবনী সুধার মাধ্যমেই জাতিকে জাগ্রত ও উন্নতির পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। তাই তিনি ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য ও অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য সাহিত্য সাধনা শুরু করলেন। এ সময়ে মুসলমানদের অধ:পতনের চিত্রটি ফুটে ওঠেছে করটিয়ায় এক জাতীয় সম্মেলনের একটি গানে। গানটি দীর্ঘদিন সবার মুখে মুখে ধ্বনিত হয় :
তোমহারা ছুরুজ ডুবু ডুবু হ্যায়
তভী তোমাহারা খবর নাহি হ্যায়,
তখ্ত তোমহারা উলট রহী হ্যায়
তভী তোমহারা খবর নাহি হ্যায়। ...
মৌলবী নঈমউদ্দীনের অর্থসম্পদ কিছুই ছিল না। কিন্তু ছিল তাঁর জ্ঞান এবং সমাজসেবা করার মতো বিশাল হৃদয়। তৎকালের করটিয়ার প্রখ্যাত জমিদার হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। করটিয়ায় তিনি স্খাপন করেছিলেন ‘হাফেজ মাহমুদীয়া যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা। এ ছাপাখানা তিনি তাঁকে ব্যবহার ও পরিচালনা করতে দিয়েছিলেন। এখান থেকে মৌলবী নঈমউদ্দীন ‘আখবারে এসলামীয়া’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এতে ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবìধ নিবìধ ফিচার ও মুসলিম বিশ্বের বিশেষ খবরাদি ছাপা হতো। প্রতি মাসের সম্পাদকীয় ছিল খুব আকর্ষণীয়। তাঁর সমাজ সংস্কারমূলক প্রবìধগুলো পাঠক সমাজের সাড়া জাড়িয়ে ছিল। ‘আখবারে ইসলামীয়া’ মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য। তৎকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারাদেশে চলতো এ পত্রিকা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কয় দশকে এবং বিংশ শতকের শুরুতে মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন ছিলেন মুসলিম বাংলার রামমোহন। এই মহাপ্রাণ মানুষটি সেদিন বাংলার মুসলমানদের আত্মসচেতন করে তোলার জন্য বক্তৃতা ও লেখনির মাধ্যমে সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারের প্রবল ঝড় তুলেছিলেন। এ সময়ে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন দেশের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিক ও সমাজসেবক। এদের মধ্যে কয়েকজন :
মুন্সী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, মুন্সী জমিরুদ্দীন, শেখ আবদুর রহীম, মোজাম্মেল হক, মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ, পণ্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদী, মোহাম্মদ গোলাম হোসেন, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মীর মশাররফ হোসেন, মুন্সী মেহেরুল্লাহ (সিরাজগঞ্জ), কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী প্রমুখ।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার দু’টি ধারা সূচিত হয়েছে মীর মশাররফ হোসেন ও মৌলবী মোহাম্মদ নঈমউদ্দীন হতে। সাহিত্যের এই দুই দিকপাল সম্পর্কে মুন্সী শেখ আবদুর রহীম বলেছেন:
‘আমার প্রথম যৌবনে যখন সাহিত্যের পুন্যক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করি, মুসলমানের জাতীয় জীবনে তখন এক সুচীভেদ্য ঘোর অমানিশা রাজত্ব করিতেছিল। ... দেখিলাম সেই অìধকার যুগেও বাঙ্গালা সাহিত্য গগনে সমাজের দু’টি ধ্রুবতারা অìধকারে আলোকচ্ছটা বিকিরণ করিতেছে, তাহার একটি পরলোকগত মীর মশাররফ হোসেন সাহেব এবং অন্যটি মৌলবী নঈমুদ্দীন মরহুম মগফুর সাহেব।’
মীর মশাররফ হোসেন আর মৌলবী নঈমউদ্দীন সমকালের দু’জন বিশাল ব্যক্তিত্ব, চিন্তা ও জীবন দর্শনের কারণে পৃথক দু’টি ধারায় সাহিত্য রচনা করেন। বলতে গেলে দু’জনই ছিলেন দু’দিগন্তের অধিবাসী। মীর মশাররফ হোসেনের ‘গোজীবন’ নামে ৬৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হলে, তার কঠোর সমালোচনা করে নঈমউদ্দীন আখবারে এসলামীয়ায় ফতোয়া প্রকাশ করেন। এতে আখবারে এসলামিয়া সম্পাদক ও মীর মশাররফ হোসেনের মধ্যে মসী যুদ্ধ শুরু হয়। এ মসী যুদ্ধ শুধু টাঙ্গাইল-করটিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বাংলা ভারতের বিভিন্ন স্খানে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। তৎকালের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সুধাকর’ মীর মশাররফ হোসেনকে সমর্থন করেনি। এ বিরোধ উল্লেখ করে মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ বলেন :
‘যখন প্রধান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন ‘গোজীবন’ নামক পুস্তক লিখিয়া মুসলমানদিগের গো মাংস ভক্ষণ ও গো কুরবানীর বিরুদ্ধে অন্যায় দোষারূপপূর্বক তীব্র মন্তব্য প্রকাশ করেন এবং তদুত্তরে অন্যতম সাহিত্যিক ও ধর্মগ্রন্থ প্রণেতা আখবারে এসলামীয়ার সম্পাদক মৌলবী নঈমউদ্দীন সাহেব ঐরূপ গ্রন্থ লেখক মুসলমানের উপর কাফেরী ফতোয়া দিয়া আখবারে এসলামীয়ায় তা প্রকাশ করেন এবং মীর সাহেব মৌলবী সাহেবের নামে মানহানির মামলা দায়ের করেন, তখন আমরা সুধাকরে অবশ্যই মৌলবী সাহেবের পক্ষ সমর্থন করিতেছিলাম। কিন্তু পণ্ডিত (রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদী) সাহেবও এ বিষয়ে আমাদিগকে বিশেষভাবে উত্তেজিত করিয়া ধর্মের পবিত্র মর্যাদা রক্ষা করিতে সনিবìধ অনুরোধ করিয়াছিলেন। তিনি বিপন্ন মৌলবী সাহেবকে নানা প্রকার সাহায্য করিতে কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন না। সে ক্ষেত্রে মীর সাহেবের বìধুতার দিকে তিনি আদৌ দৃকপাত করেন নাই।’
মৌলবী নঈমউদ্দীন মীর মশাররফ হোসেনকে কাফের ফতোয়া দিলে টাঙ্গাইল থেকে মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের সম্পাদনায় পাক্ষিক হিতকরীতে বাদানুবাদ শুরু হয় এবং তা দীর্ঘকাল চলে। তারপর পণ্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদীর চেষ্টাতে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ একটা মিটমাট হয়ে যায়। মীর সাহেব ‘গৌজীবন’ পুনমুদ্রিত করবেন না বলে আশ্বাস দিলে মৌলবী সাহেব তাঁর তারিফ করেন। আদর্শের দিক থেকে দুই সাহিত্যেকের মধ্যে মসী যুদ্ধ হলেও ব্যক্তি জীবনে তাদের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল প্রচুর। প্রায়ই তাঁরা একত্র মিলিত হয়ে পারিবারিক সুখ-দু:খ থেকে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন।
মৌলবী নঈমউদ্দীনের জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ, পবিত্র আল কুরআনের বঙ্গানুবাদ। তাঁর অনুবাদের প্রত্যেকটি আয়াতের অংশসমূহ আলাদা আলাদাভাবে আরবী হরফে মুদ্রিত করে তার নিচে সে অংশের বাংলা তরজমা এবং তার পরে অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে তার ব্যাখ্যা ও বিস্তৃত তফসীর করেছেন। তাঁর অনূদিত কুরআন শরীফ প্রথম খণ্ড ১৮৯১ ইছায়ী সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংস্করণ ১৮৯২ সালে হাফেজ মাহমুদ আলী খান পন্নী জমিদার সাহেবের অনুগত্যানুসারে করটিয়া মাহমুদীয়া যন্ত্রে ছাপা হয়। এই ছাপাখানা থেকে তৃতীয় খণ্ডও প্রকাশিত হয়। তৃতীয় খণ্ড ছাপা হওয়ার পর তিনি কলকাতা চলে যান এবং জলপাইগুড়ির জমিদার খানবাহাদুর রহিম বক্স খানের অর্থানুকূল্যে তাঁর অনূদিত কুরআন শরীফের ৭ম, ৮ম ও ৯ম পারা পর্যন্ত প্রকাশ করেন। ১০ম পারা মুদ্রণ শেষ হওয়ার পূর্বেই ১৯০৮ সালে ২৩ নবেম্বর মৌলবী নঈমউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। তিনি সর্বমোট তেইশ পারা পর্যন্ত অনুবাদ করেন। অবশিষ্ট অংশ তাঁর পুত্র কাছেম উদ্দীন ও ফখরুদ্দীন আহমদকে অনুবাদ ও প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়ে যান।
মৌলবী নঈমউদ্দীন ফতয়ায়ে আলমগিরী বাংলায় অনুবাদ করে চার খণ্ডে প্রকাশ করেন। তিনি বুখারী শরীফের অনুবাদ করেন। কিন্তু বুখারী শরীফের আংশিক না সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি।
অন্যান্য রচনাবলী
মৌলবী নঈমউদ্দীন রচিত আরো কিছু পুস্তক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে :
১. কালেমাতল কোফর, ২. এছাবাতে আখের জ্জোহর, ৩. এনসাফ, ৪. রফা-এদায়েন, ৫. আদেল্লায় হানিফীয়া, ৬. মায়াদানোল ওলুম, ৭. ইউসুফ সুরার সুবিস্তৃর্ণ তফসীর, ৮. সেরাতল মস্তাকিম, ৯. সেরাতল মস্তাকিম (নব পর্যায়), ১০. ধর্মের লাঠি, ১১. বেতের, ১২. তারাবিহ।
এগুলো ব্যতিত পুঁথির ভাষায় এবং পুঁথির আদর্শে আরো কয়েকটি জীবন চরিত লিখেছিলেন। এগুলো হচ্ছে :
১. ছহী শাহ আলমের কিচ্ছা, ২. ছহী শের সাহেবের কিচ্ছা, ৩. ছহী আলমগীরের কিচ্ছা, ৪. ছহী নূরজাহান বেগমের কিচ্ছা, ৫. ছহী আলাউদ্দীনের কিচ্ছা, ৬. ছহী হোসেন শাহের কিচ্ছা, ৭. গোকান্ড।
মৌলবী নঈমউদ্দীন তাঁর আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করে যেতে না পারলেও মুসলিম সমাজে আল কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী হিসাবে অক্ষয় যশের অধিকারী হয়ে আছেন। তৎকালে মুসলিম সমাজে তাঁর মতো অসাধারণ জ্ঞানী আলেম এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও অনুবাদকারী আর কেউ ছিলেন না। অসাধারণ বাগ্মী হিসাবেও তিনি সারাদেশে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।