Saturday, June 27, 2009

বনসাই

বনসাই
আব্দুল ওয়াহেদ


বনসাই যুগপৎ হতাশা, ক্রোধ ও ঘৃনা নিয়ে আসে।

ছোট্ট একটা কুঠুরীতে বন্দী প্রাণ ভোমরা। শিল্পের নামে সৌন্দর্যের নামে বাণিজ্যের নামে এই আজব লীলা। ...৩৭ বছর বয়সী বনসাইয়ের দাম ৫৫ লাখ টাকা। একটা বৃক্ষ শিশুকে বছরের পর বছর অগুনিত অত্যাচার করে তার নাম দিই শিল্প। জানি না এই শিল্পের কি মূল্য। শিল্পের মূল্য এতোই টুনকো.... অপর একটি প্রাণের অস্তিত্ব , বিকাশকে ধ্বংস করে দেয়। শিল্পের জন্য শিল্প- এর কোন মূল্যই হতে পারে না। সে অর্থহীন। মানুষের এই বর্বরতার মধ্য সে তার জঘন্য প্রবৃত্তিগুলোকে চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমার মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় পড়া 'চীন জাপানের শিশু' লেখাটি। মেয়েদের পায়ের আকার ছোট হলেই নাকি সৌন্দর্য, তাই লোহার জুতো পড়িয়ে রাখা হতো। অনেক আগে রহস্যপত্রিকায় কোন এক উপজাতি গোষ্টির উপর একটা লেখায় পড়েছিলাম, তারা মেয়েদের গলা লোহার পাত দিয়ে মুড়িয়ে দিত। একসময় গলাটা লম্বা হয়ে যেতো। এই হলো সৌন্দর্য। এই সকল সৌন্দর্য কলা না নির্যাতন ! যখন আমাদের দেশের শিশুরা উটের জকি হয়ে বাজারে বিক্রি হয় তখন কেন তা আর শিল্প হয়ে উঠে না।

বিকৃতিতে আমাদের পরিবেশ প্রাণ বৈচিত্র্য থমকে গেছে। ঝরাগ্রস্থ পৃথিবীতে আমরা হাজারো শংকা নিয়ে বসবাস করছি। ধর্মগ্রন্থ অথবা মানবিক জ্ঞান সবাই মানুষকে বসায় শ্রেষ্টত্বের আসনে। এই মানুষ কোন মানুষ আমরা কি খেয়াল রাখি। মনে হয় রাখি না। ব্যক্তি স্বাধীনতা বা আপন বুঝাপড়ার শূন্যতায় জগত ভেসে যায়- তখন মানুষ নিজেও হয়ে অন্য কোন নিয়তির হাতে গড়া পুতুল। সে জানে না আপনাকে চিনতে তার নিজের ভূমিকা কি।

আমাদের কোন আচরনই অনর্থক নয়। তা কোন না কোন ফল উৎপাদন করে এবঙ বিচারযোগ্য। ভালো বা মন্দ সকল কিছু চর্চার বিষয়। আপনি যখন একটা প্রানের উপর অত্যাচার করেন, একই সাথে সে অত্যাচারের চর্চা করছেন, যা মানুষের উপরও করতে পারেন। ভালো বা মন্দ যেকোন আচরন অভ্যাসের ভেতর এমন স্থানে পৌছে, যখন আপনাকে ভালো বা মন্দ কাছের ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে না। আপনার অবচেতনই সে কাজটির দিকে নিয়ে যাবে।

কিছু গল্প শোনা যাক..

হযরত মুসা (আঃ) একটা জলাশয়ের পাশ দিয়ে যেতে খেয়াল করলেন, জলাশয়ের পানি কালো বর্ণ ধারন করেছে। তিনি আল্লাহর কাছে এর কারন জানতে চাইলে আসমান থেকে উত্তর আসল, " এই জলাশয়ের পানি দ্বারা একজন পাপিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে ধৌত করেছে।"
মুসা অবাক হয়ে বললেন," একলোকের কারনে সকলের ক্ষতি।"
এটি তার কাছে নায্য মনে হলো না।
মুসা (আঃ) গাছের চায়ায় ঘুমাচ্ছিলেন, হঠাৎ পিপড়ের কামড়ে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তিনি দেখলেন এক ঝাক পিপড়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। রেগে গিয়ে তিনি পুরো দলটাকে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেললেন। তখন আসমান থেকে বলা হলো," হে মুসা, তোমাকে একটা পিপড়ে কামড়িয়েছে আর তুমি সবগুলোকে মেরে ফেললে।"

সম্ভবত হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাঃ)'র কাহিনী।
তিনি একবার কোথা যেন যাচ্ছিলেন। অনেক পথ চলার পর খেয়াল করলেন তার জামার মধ্যে একটা পিপড়ে আটকে আছে।
তিনি যেদিক হতে এসেছিলেন সেদিকে হাটা শুরু করলেন। কয়েক ক্রোশ আসার পর দেখতে পেলেন পিপড়ের সারি, তখন তিনি পিপড়েটাকে সেই সারিতে রেখে পুনরায় গন্তব্যে রওয়ানা দিলেন।

কোন এক সাধুর গল্প।
তিনি দেখতে পেলেন একটা বৃশ্চিক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে পানি জলাশয়। অর্থ্যাৎ বৃশ্চিকটার বিপদ। তিনি বৃশ্চিকটাকে হাতে নিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেলেন। কিন্তু বৃশ্চিকটা তার হাতে কামড় দিলো, আবার আগের পথে রওয়ানা দিলো। তিনি আবার একই কাজ করলেন।
তার শিষ্য বলল," আপনাকে কাপড় দেয়া সত্ত্বেও আপনি আবার একই কাজ করলেন।"
সাধু বললেন," বৃশ্চিকের ধর্ম কামড় দেয়া। সে তার ধর্ম পালন করেছে, আমি আমারটা।"

এবার নিজের কথা বলি।
আমার একটা নদী ছিলো।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা যেকোন নাম দিতে পারেন।
আপনারা শুধু বৃক্ষের বনসাই দেখেছেন।
আমি নদীকে বনসাই বানাচ্ছি।
চমৎকার শিল্প হবে।

"আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে..."
শিশুটি আমাকে বলল," নদী কি?"
" বাবা তোকে তো আসল নদী দেখাতে পারব না। নদীর বনসাই দেখ।"
শিশুটি বলল," ওয়াও! অনেক বড়ো।"

দো'টানা

দো'টানা
আব্দুল ওয়াহেদ


"হে প্রভু নিজেরে বুঝার ক্ষমতা দাও!"

এই নিজ আর আমি'র মধ্যে কি যেন এক পার্থক্য আছে। যতবার বলতে চাই আমি, কে যেন টুটি চেপে ধরে বলে, সীমা লঙ্ঘন করিস না। সীমা!! অদ্ভুত লাগে আমিত্বের সীমা লঙ্ঘন কি 'আমি' উচ্চারণের ভেতর দিয়ে ঘটে। এর জবাব পাই না। তাহলে নিজের ভেতর এমন দ্বন্ধের আভাস মেলে যারে আমি বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝলাম এর মীমাংসা চাই।

মীমাংসায় যাওয়ার আগে প্রশ্ন জাগল, কেন নিজেরে বুঝতে হবে?
যেহেতু সত্য জানতে চাই, তার যাত্রাবিন্দু থাকতে হবে। নাহলে হাভাতে ঘুরতে হবে। ধাধাঁর পর ধাধাঁয় পড়ার রিস্ক না নিয়ে কিছু উত্তর পাবার চেষ্টা করি।

নিজেকে দিয়ে শুরু করার জন্য কিছু পূর্বানুমান ছিলো, যেমন- এই জটিল জগতে কোন জিনিসটা বেশী চেনা-জানা ইত্যাদী।
কিন্তু যখন 'আমি কে?' চিরন্তন প্রশ্ন পরলাম ফাপরে। আসলে আমি কে? ডানে বায়ে তাকিয়ে দুই একটা কথা বলার চেষ্টা করলাম। যেমন- জৈবিক সত্ত্বা, বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি। ওমা !! নিজের উত্তরে নিজেরেই সামাল দিতে পারি না। যাই বলি সে হাসে। মোটা দাগে আমার ভেতর এমন কিছু আছে, যা আমি নিজেও ধরতে পারছি না। বুঝলাম সাধে কি সক্রেটিস বলেছেন, নিজেকে জানো। বেদ, কুর'আন আরো এগিয়ে বলে, যে নিজেকে জেনেছে, সে স্বীয় রবকে জেনেছে।

এইখানে এসে বুঝলাম প্রশ্নটা ঠিক আছে। যুগে যুগে মহামানব'রা ( কোন না কোনভাবে সকল মানুষ) নিজেকে বুঝার সংগ্রামটা করে গেছেন। এই প্রশ্নের হয়ে নিজের ভেতর নানান ভরকেন্দ্রের চাপ অনুভব শুরু করি। ভরকেন্দ্রের বর্ণনা পুরোপুরি দেয়ার ভাষা নাই, কারণ তারা একে অপরের সারাক্ষন কুস্তি খেলে। যে যখন জয়ী হয় আমি বলি তুমি সহী। যেমন যখন নিজের দেখা, বর্ণনা, ভাব, ভাষার কথা বলি বাহ! বাহ! তুমি ঠিক। কিন্তু পর সচেতন বলে এতো নিশ্চিত হচ্ছো কেমনে? তখন সবকিছুকে সাপেক্ষ হিসেবে ছাড় দিয়ে আমার নিজের বলে কিছুই থাকে না। এর ওর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আপনাকেই হারিয়ে ফেলেছি। তখন দো'টানাই পড়ি।

আচ্ছা এই দো'টানাই কি আমি নিজে! হতে পারে। জগতে আর কেউ কি আছে যে মানুষের মতো দ্বৈত জীবন যাপনকারী !

জোছনা আমার বোন

জোছনা আমার বোন
আব্দুল ওয়াহেদ

আমার জম্ম আষাঢ়ী পূর্ণিমায়।

আমার মা স্বপ্নে দেখেছিলেন, তার এক কোলে সূর্য, অন্য কোলটা খালি। চাঁদ ঝুলে আছে ঠিক তার মাথার উপর । তিনি বললেন, বাছা তুইও আমার কোলে আয়। সাথে সাথে চাঁদ নেমে আসল তার কোলে।

এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেন আমার দাদীমা। তিনি বললেন, বউ
তোর যমজ বাচ্চা হবে। সূর্য হলো ছেলে আর চাঁদ হলো মেয়ে। আমার মা এমন ভাব করলেন, এ আর কি ? আমিও বুঝেছি। নামও ঠিক হলো, ছেলের নাম সুরুজ আর মেয়ের নাম জোছনা। আমার বাড়ী পালানো স্বভাবের বাবা বাড়ী ছাড়ার ধারে না দিয়ে, বউয়ের যত্ন আত্তি মনোযোগ দিলেন। তিনি সুরুজ আর জোছনা নিয়ে নতুন গান বাঁধলেন। সময়ে অসময়ে মাকে গান শুনাতেন। মা বড়ই লজ্জা পেতেন। মা ভালো গান জানতেন।

একটানা তিনদিনের বৃষ্টি। চারদিকে কাদা পানি। বৃষ্টি ঠেলে বাবা গেলেন দাই ডাকতে। ঘরের দাওয়ায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি থেমে গেলো। তিনি আমার কান্না শুনতে পেলেন। বাইরে চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠল পৃথিবী। তিনি কান পেতে রইলেন অন্য শিশুটির কান্না শোনার আশায়।

আমার নাম সুরুজ।
আমার আর কোন ভাই-বোন নেই। আমার বাবা কোন দূরদেশে চলে গেছে কেউ জানে না। হঠাৎ হঠাৎ খবর আসত তাকে এই হাটে ও ঘাটে দেখা গেছে। আর আমার মা অদ্ভুত ঘোরের ভেতর জীবনপাত করে গেলেন। তার অদৃশ্য মেয়েটা ছিলো তার চোখের মনি।

তিনি সারাক্ষন জোছনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। হয়তো আমাকে ডেকে বলতেন, 'তুই জোছনার সাথে খেলা কর, আমি তরকারীটা দেখে আসি।'
একসময় আমার দাদার বাড়ীর লোকেরা মাকে তার বাপের বাড়ীতে রেখে আসল। শুনেছি তিনি মারার সময় শুধু এই বলতে লাগলেন, 'আমি মারা গেলে জোছনাকে কে দেখবে?'
আমার নানী কাদঁতে কাদঁতে বললেন, 'আমি আছি না? তুই শান্ত হ।'
মা মুখে হাসি নিয়ে মারা গেলেন।

আমার জীবনের আট দশটা সাধারন ঘটনার মতোই বাড়ি ছাড়ি। বাড়ি নামের শব্দটি আমার অনুভূতিতে কোন আবেগীয় প্রকরন হিসেবে হাজির হয়নি। বরঙ, জাগতিক অর্থহীনতারুপেই তাকে দেখেছি।

নানান দেশের নানা পথ ঘুরে কোন এক স্বপ্নকে তাড়া করেছি যেন।

আমার মা বা বাবা কারো কোন ছবি আমার মাথায় আসে না। এক বর্ষার রাতে মন কেমন যেন আকুলি বিকুলি করছিল। কোন ধরনের বৈপরীতে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই ছোট্ট মেয়েটিকে। তখন বুঝতে পারলাম আমার ছোট বোনটি আমার ভেতরই রয়ে গেছে।

আমার মা ক্রমাগত সেই বোধটি আমার ভেতর ঢুকিয়ে গেছেন, তাকে আমি কখনো অতিক্রম করে আসতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষনে সবকিছুকে নিস্ফল মনে হয়, যেন অবচেতনে কোন সংস্কারকে নিজের সাথে বেঁধে রাখছি। আবার ভাবি জীবন মানে কি? যুক্তি সর্বস্বতা, নৈব্যক্তিকতা এসব কি? যুক্তি নিজে দাড়িয়ে থাকে অনুমানের উপর আর নৈব্যক্তিকতা তো অলীক কল্পনা।

আমার সকল নির্মোহ চেতনা ধ্বসে যায় যেন। ধাবমান পৃথিবীতে কিছু একটা আকঁড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ অনেকদিন পর মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। বাবার বৈরাগ্যের অর্থহীনতা তাকে অলীক সন্তানের ভেতর ঠেলে দেয়। মা তার বাস্তব জগতকে এমনভাবে দলিত করেছেন, যেখানে আমি যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।

জানি না জোছনা নামের মেয়েটি আমার ভেতর কেমন করে বসত করে। সে আমার সহদোরা। আমার আমিত্বের প্লাবনটাতে ক্রমশ সে স্থান করে নেয়। আমার মায়ের মতো কি? আমার ভেতর স্নেহের যে আকুলতা আছে তা টের পেতে থাকি। জোছনা আমার সাথে বলে। গান শুনায়। তার গলা অবিকল মায়ের মতো। জানি না এটা কেমন করে বললাম। জীবনের কাঙ্খাগুলো স্পষ্ট উঠে। হাঁ জীবন মানে মায়া, আর কি!

এক সময় বাবাও যেন আমার ভেতর গেড়ে বসে। অদ্ভুতভাবে ঘটনা চক্রে তার সাথে আমার দেখা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করি সংসারে আপনার কে কে আছে? তিনি বলেন, 'জোছনা নামের একটা মেয়ে আছে।' আমি বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাই। তিনি কিছুই টের পান না। তার হাতের বাদ্য যন্ত্রটা বাজাতে থাকেন।

তখন আমিও পুরোপুরি নিমজ্জিত হই জোছনা নামক বিভ্রান্তিতে। যার থেকে আমার মা, বাবা কেউ মুক্তি পাননি। বুঝলাম, সংসার নামক অদ্ভুত জিনিসটি কিছু না কিছুতে ভর দিয়ে টিকে থাকে। জোছনা নামক অলীক মেয়েটি আমাদের অদৃশ্য সংসারকে টিকিয়ে রেখেছে।

আমি জোছনার হাতটা ধরে বলি, চল এই আজব দুনিয়াটা ঘুরে দেখি।
জোছনা শুধু মাথা নাড়ায়।